নারায়ণগঞ্জে আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে চুরি ছিনতাইয়ের মত ঘটনা। মধ্যরাত থেকে ভোর পর্যন্ত এমনকি দিনে-দুপুরেও অহরহ ঘটছে ছিনতাইয়ের ঘটনা। এসব ঘটনায় প্রতিদিন মানুষ মূল্যবান জিনিস যেমন খোয়াচ্ছে তেমনি আহত ও নিহত হওয়ার সংখ্যাও বাড়ছে। কম হলেও নারায়ণগঞ্জে চিহ্নিত প্রায় ১০ থেকে ১৫টি ছিনতাইয়ের স্পট আছে। এসব ছিনতাইয়ের স্পটগুলোর মধ্যে শুধুমাত্র বঙ্গবন্ধু সড়কেই রয়েছে ৫ থেকে ৭টি ছিনতাইয়ের স্পট। এ স্পটগুলো হলো, শহরের চাষাঢ়া শহীদ মিনার, শান্তনা মার্কেট, গ্রানলেজ ব্যাংকের মোড়, স্বর্ণপট্টি মোড়, ২নং রেলগেট, করিম মার্কেট ও মন্ডলপাড়া এলাকা। এছাড়া শহরের ১নং রেলগেট, লঞ্চ টার্মিনাল, ১নং খেয়াঘাট, মাসদাইর ঈদগাহ্ মাঠ, পঞ্চবটি মোড়, ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিঙ্ক রোড, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক, সাইনবোর্ড, চিটাগাং রোড, কাঁচপুর অন্যতম। যেখানে প্রতিনিয়ত তৎপরতা চালাচ্ছে ছিনতাইকারী চক্র।
ছিনতাই প্রতিরোধে নারায়ণগঞ্জ পুলিশ প্রশাসন কার্যত দৃশ্যমান কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না। ফলে দিন দিন বেড়েই চলছে ছিনতাইকারীর দৌরাত্ম্য।
শহরের চাষাঢ়া শহীদ মিনার, শান্তনা মার্কেট, গ্রানলেজ ব্যাংকের মোড়, স্বর্ণপট্টি মোড়, ২নং রেলগেট, করিম মার্কেট ও মন্ডলপাড়া এলাকায় মোটকথা পুরোবঙ্গবন্ধু সড়ক জুড়েই চলে ছিনতাইকারিদের আধিপত্য। বিভিন্ন কাজে এ পথে আসা সাধারণ মানুষগুলোর হানা দেয় ছিনতাইকারি দল। অনেক সময় তাদের হাতে থাকে ধারালো অস্ত্রও। প্রতিদিন মোবাইল, টাকা পয়সা থেকে শুরু করে বিভিন্ন মূল্যবান জিনিসপত্র ছিনতাই করে নিয়ে যায় এই সংঘবদ্ধ ছিনতাইকারি চক্রটি।
গত ৯ নভেম্বর শহরের ২নং রেলগেট এলাকায় সুইচ গিয়ারের ভয় দেখিয়ে দিনে দুপুরে ছিনতাই ঘটনা ঘটে। প্রায় পঞ্চাশ বছরের এক বয়স্ক ব্যক্তিকে ওই সুইচ গিয়ারের ভয় দেখিয়ে ছিনতাইয়ের সময় এক ছিনতাইকারিকে হাতে নাতে ধরে উত্তম মধ্যম দেয় জনতা। ওই সময় ছিনতাইকারির কাছ থেকে টাকা ও অস্ত্রটি উদ্ধার করে জনতা। এ এলাকায় প্রতিনিয়ত এমন ছিনতাইয়ের ঘটনায় সাধারণ জনগণ থেকে শুরু করে দোকানীরা বিপাকে রয়েছেন বলে গণমাধ্যমকর্মীদের জানিয়েছিলেন। তারা এ বিষয়ে পুলিশ প্রশাসনের কঠোর হস্তক্ষেপ কামনাও করেন।
গত আগস্টের প্রথম দিকে বাবার সাথে নিজ গ্রামের বাড়ী যাওয়ার পথে ১নং খেয়াঘাট এলাকায় ছিনতাইকারির কবলে পড়ে সর্বস্ব খোয়ান এক গৃহিনী। তার সাইট ব্যাগ থেকে একটি এন্ড্রোয়েট মোবাইল ও সমস্ত স্বর্ণালোঙ্কার ছিনতাই হয়। ওই ঘটনায় গৃহিনী চিৎকার করে কেঁদেও কারো সহযোগীতা পান নি।
শহরের গ্রীণলেজ ব্যাংকের মোড়ে এখনও সক্রিয় রয়েছে প্রায় তিন চারটি ছিতাইকারি চক্র। তারা প্রতিনিয়ত বহু সাধারণ মানুষের মোবাইল, টাকা পয়সা ও স্বর্ণালোঙ্কার লুট করে চলেছেন। এ বিষয়টি ওপেন সিক্রেটভাবে চললেও পুলিশ প্রশাসনের তেমন কোন উদ্যোগ এখনও চোঁখে পড়েনা। ফলে অনেকটা বীরদর্পেই চলছে এ ছিনতাইয়ের ঘটনা।
এদিকে রাত হলেই ভয়ংকর হয়ে উঠে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিঙ্ক রোড। বিশেষ করে লিঙ্ক রোডের শিবু মার্কেট থেকে জালকুড়ি কড়ইতলা পর্যন্ত এলাকায় প্রতিনিয়তই ঘটছে ছিনতাইয়ের ঘটনা। পরিবহন শ্রমিক থেকে ব্যবসায়ী, কেউ রক্ষা পাচ্ছেনা ছিনতাইকারিদের কবল থেকে।
স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানাগেছে, ছিনতাইয়ের আগে তিনটি লাল রঙের হোন্ডারে (মটরসাইকেল) করে মোট ৬ জন ছিনতাইকারি সারা সড়ক মহড়া দেয়। তারা সবাই এক রঙের গেঞ্জি ও মাস্ক পরে আসে। তারপর তারা দূর থেকে টার্গেট করে। সুযোগবুঝে দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে সাধারণ মানুষের ওপর। তাদের হাতে চাপাতি, লোহার রড, ব্ল্যাড ইত্যাদি অস্ত্র থাকায় মানুষ অনেকটা ভয় পেয়ে যায়। তারপর তারা আরও অন্ধকারাচ্ছ স্থানে নিয়ে নিরিহ মানুষের কাছ থেকে সর্বস্ব কেড়ে নেয়। কেউ টাকাপয়সা না দিতে চাইলে তাকে কুপিয়ে জখমও করা হয়। তারা বেশিভাগ ব্যবসায়ীদেরই টার্গেট করে। প্রতিরাতে তারা ছোট-বড় কোন না কোন ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটিয়েই থাকে। রাত ১২টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত চলে তাদের এ ছিনতাইয়ের ঘটনা। গত ৫ আগস্টের পর থেকে এই পর্যন্ত এ জায়গায় কমপক্ষে প্রায় অর্ধশতাধীক ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। আর এসব ঘটনায় ছিনতাকারিদের ছুড়িকাঘাতে আহত হয়েছেন ১০-১৫ জন সাধারণ মানুষ। তবে এসব বেশিরভাগ ঘটনায় হয়রানী হওয়ার ভয়ে বেশিরভাগ ভুক্তভোগী থানা পুলিশের তেমন কোন সহযোগী নেননি বলেও জানান স্থানীয় এলাকাবাসী।
এ বিষয়ে শিবুমার্কেট এলাকার আহাম্মদ আলী নামে এক ডিম ব্যবসায়ী জানান, কিছুদিন পূর্বে তিনি মটরসাইকেলে করে তার দোকান থেকে বাসায় যাওয়ার পথে ছিনতাইকারিরা তার পিছু নেয়। দু’টি মটরসাইকেলে প্রায় ৬ জন ছিনতাইকারি তার পিছু নিলে তিনি তার লোকিংগ্লাসে দেখে ফেলেন। পরে তিনি দ্রুত জালকুড়ি কড়ইতলা এলাকায় গিয়ে দৌড়ে একটি চায়ের দোকানের সামনে গিয়ে আশ্রয় নেন। কারণ, ওখানে রাস্তায় দারোয়ান থাকে। কিন্তু তবুও ছিনতাইকারিরা ওখানে গিয়েও তাকে ধরার চেষ্টা করে। পরে তিনি ও দারোয়ান ঢিল ছুড়ে ছিনতাইকারিদের প্রতিরোধ করেন।
এছাড়া তিনি জানান, গত ৮ আগস্ট ভোর ৪টা ৪০ মিনিটে লিঙ্করোড সংলগ্ন শিবু মার্কেট এলাকায় তার টয়োটা কোম্পানীর কেমি মডেলের এক জীপ গাড়ী (ঢাকা মেট্রো ঘ-১১-৪৮৪৭) রেখে একটি মসজিদে নামাজ পড়তে যান। নামাজ শেষে এসে দেখে গাড়ীটি নাই। পরে তিনি জানতে পারেন কোন এক চোর চক্র তার গাড়ীটি নিয়ে ঢাকার দিকে চলে যাচ্ছে। তিনি সাথে তার মটরসাইকেল করে গাড়ীটির পিছু নেয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু তার মটরসাইকেলের তেল শেষ হয়ে যাওয়ায় গাড়ীটির পিছু নেয়া আর সম্ভব হয়নাই। পরে তিনি এ বিষয়ে ফতুল্লা মডেল থানায় একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। কিন্তু এখনও পর্যন্ত তার জীপ গাড়ীটি ফিরে পাননি।
এর আগে জালকুড়ি থেকে মুদিদোকানের তাগদা করে শিবু মার্কেটের দোকানে ফিরছিলেন আশরাফুল নামে এক যুবক। আশরাফুল শিবু মার্কেট এলাকার কামালের মুদিদোকানের কর্মচারি। ওইদিন তিনি স্টেডিয়ামের ময়লাস্তুপের সামনে এলে তাকে ঘিরে ফেলে ছিনতাইকারিরা। এসময় তার সাথে থাকা তাগদার নগদ ৩ লাখ ৭০ হাজার ৫শ টাকা ছিনিয়ে নিতে চায় ছিনতাইকারিরা। কিন্তু আশরাফুল কোন অবস্থাতেই টাকা দিতে রাজি ছিলো না। ফলে তার সাথে অনেক ধস্তাধস্তি হয় ছিনতাইকারিদের। কিন্তু ধস্তাধস্তিতেও কাজ না হওয়ায় আশরাফুলকে কুপিয়ে আহত করে টাকা নিয়ে যায় ছিনতাইকারিরা। পরে স্থানীয়রা আশরাফুলকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। এ ঘটনায় ফতুল্লা মডেল থানায় একটি জিডিও করা হয়। কিন্তু তবুও খোয়া যাওয়া সেই ৩ লাখ ৭০ হাজার ৫শ টাকা ফেরত পাওয়া যায়নি।
ছিনতাইয়ের শিকার হওয়া একাধীক ভুক্তভোগীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, রাস্তায় যেভাবেই যাতায়াত করুন না কেন যথেষ্ট সচেতন থাকার পরেও অনেক মানুষকে নিয়মিত এ ধরণের সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। কিছু জায়গা আছে যেখানে ছিনতাইয়ের স্পট হিসেবে মানা হচ্ছে কিন্তু ওই সব জায়গায় যথাযথ পুলিশী টহল বাড়ানো হচ্ছে না। অনেক জায়গায় এখনো সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন করা হয় নি। এছাড়া তাৎক্ষণিক সুফল পাওয়া যায় না বলে ভুক্তভোগীরা বেশির ভাগই আইনের আশ্রয় নেন না।
ভুক্তভোগীদের দাবি, পুলিশ-প্রশাসনের নজরদারী জোরদার করতে চিহ্নিত স্পট গুলোতে এলাকাভিত্তিক সিসি টিভি ক্যামেরা বসানো হোক। এতে ছিনতাইকারী শনাক্ত করার পাশাপাশি সাধারণ মানুষকে নিরাপত্তা দেয়া সহজ হবে বলে মনে করেন তারা।
এ বিষয়ে নারায়ণগঞ্জ পুলিশ প্রশাসন বলছে, ছিনতাইয়ের ঘটনায় ভুক্তভোগীরা যাতে তাৎক্ষণিক প্রসাশনের সাহায্য নেয়, সে জন্য পুলিশের চেষ্টার কোন কমতি নেই। যাদের বিরুদ্ধে একাধিক ছিনতাইয়ের মামলা আছে, বিশেষ করে যারা এই ধরনের অপরাধ আগেও করছে তাদেরকে আমরা ইনফর্মারদের দ্বারা নজরে রাখি। তবে ঘটনা ঘটলেও বেশির ভাগ ভুক্তভোগী মামলা না করায় পুলিশ জড়িত ব্যক্তিদের সহজে শনাক্ত করতে পারে না বলেও জানান তিনি।