নারায়ণগঞ্জের অন্যতম ব্যস্ততম সড়ক ‘বঙ্গবন্ধু সড়ক।’ এ সড়কটির দু’পাশে গড়ে উঠেছে অনেক গুরুত্বপূণ স্থাপনা। এসব স্থাপনার মধ্যে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল, ডায়াগনষ্টিক সেন্টার, ব্যাংক, পোষাক কারখানা, আটা ময়দা ও চাউলের আড়ত, বড় বড় রেষ্টুরেন্ট, কমিউনিটি সেন্টার, সুপার মার্কেট, শপিং মল ইত্যাদি। কোর্টে আসা-যাওয়া বা ব্যবসার কাজেও এ সড়কে প্রতিদিন লাখো লাখো মানুষের পদচারণা ঘটে। এছাড়া মহল্লায় মহল্লায় কাঁচাবাজার থেকে শুরু করে চাল, আলু, পেঁয়াজ, ফলমূলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক দ্রব্যের আড়ত এ সড়কের পাশেই। আছে সরকারি-বেসরকারি ঐতিহ্যবাহী অসংখ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ঐতিহাসিক অনেক স্থাপনাও রয়েছে এ সড়কের খুব কাছকাছি।
নানা কারণে এ সড়কটি গুরুত্বপূর্ণ হলেও যানজটের কারণে এখানে আসার কথা ভাবলে আঁতকে ওঠেন অনেকে। দিনের পর দিন চলা তীব্র যানজটে নাজেহাল-হয়রান এই এলাকার বাসিন্দা থেকে শুরু করে বিভিন্ন কাজে দূর-দূরান্ত থেকে আসা যাত্রী ও যানবাহনের চালকেরা।
বঙ্গবন্ধু সড়ক এলাকা ঘুরে, পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ, যানবাহনের চালক-যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে যানজটের বেশ কয়েকটি কারণ। তারা জানান, বঙ্গবন্ধু সড়কে অনেকটা বাধাহীনভাবেই প্রতিনিয়ত ঢুকছে অনুমোদনহীন ব্যাটারি চালিক রিকশা, অটোরিকশা ও মিশুকের মত পরিবহন। তাছাড়া আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারি বাহিনীর শিথিলতার কারণে সড়ক ও ফুটপাত দখল, অবৈধভাবে পার্কিং বাড়িয়ে দিচ্ছে যানজটের তীব্রতা।
রাস্তার ওপর দোকান
ফুটপাট দখলের পর এবার প্রায় বঙ্গবন্ধু সড়কটিই দখল করে বসেছে হকাররা। সড়কের বেশিরভাগ অংশ দখল করে বসানো হয়েছে দোকানপাট। শহরের মন্ডলপাড়া এলাকা থেকে শুরু করে চাষাঢ়া পর্যন্ত ফুটপাত দখল করে বসেছে দোকানপাট। শুধু তাই নয়, সঙ্গে ওই সড়কের দু’পাশের দুইটি লেন দখল করেও বসানো হয়েছে দোকান। গত ৫ আগস্টের পর এ দোকানপাটের সংখ্যা বেড়েছে প্রায় দ্বিগুন। ফলে ফুটপাট কিংবা সড়কে পাঁ ফেলার মতোও এতটুকু জায়গা পাওয়া যাচ্ছেনা। সেখানে কোনোমতে একটি গাড়িকে জায়গা করে নিয়ে চলতে হচ্ছে। আর এসব কারণে বহু যানবাহন আটকা পড়ে সৃষ্টি হচ্ছে ভয়াবহ যানজটের।
অবৈধ ট্রাকস্ট্যান্ড
হকার সমস্যা ছাড়াও পুরো মন্ডলপাড়া-নিতাইগঞ্জ জুড়ে অবৈধ ট্রাকস্ট্যান্ডও দায়ী এই যানজটের জন্য। মন্ডলপাড়া এলাকায় গেলেই দেখা যাবে সড়কের দু’পাশ জুড়ে ট্রাক পার্কিং করে সড়ক দখল করে আছে। ফলে এ ট্রাকস্ট্যান্ডের কারণে সড়ক সুরু হয়ে যাওয়ায় যানবাহন নির্বিঘেœ চলাচল করতে পারছে না। ফলে ওই এলাকায় তীব্র যানজট সৃষ্টি হচ্ছে। অথচ এখানে রয়েছে নারায়ণগঞ্জ ১শ শয্যা বিশিষ্ট (ভিক্টোরিয়া) হাসাপাতাল ও নগরভবন। যানজটের কারণে হাসপাতাল ও নগরভবনে আসা সাধারণ মানুষ ও রোগীদের প্রতিনিয়ত পড়তে হচ্ছে চরম দুর্ভোগে। দেখাগেছে, সেই দুর্ভোগ ও যানজটের প্রভাবও পড়ছে এ সড়কেও।
ভুক্তভোগীরা কী বলছেন
বঙ্গবন্ধু সড়কের যানজটে সাধারণ মানুষ যেমন অতিষ্ঠ, তেমনি বিরক্ত বাস ও বিভিন্ন যানবাহনের চালকেরাও। যানজটের বিষয়ে বন্ধন বাসের এক চালক বলেন, নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকা গুলিস্তান যেতে আগে সর্বোচ্চ সময় লাগতো ৪০-৪৫ মিনিট। কিন্তু যানজটের কারণে এখন তিন ঘণ্টারও বেশি সময় লাগে। আগেতো শুধু ঢাকায় জ্যাম থাকতো। এখন ঢাকার চাইতে নারায়ণগঞ্জের জ্যাম বেশি। এই জ্যামে বসে যে জীবনের কতো হাজার ঘণ্টা পার করতেছি তার হিসাব নাই।
তিনি আরও বলেন, সবাই শুধু জ্যাম হলেই আমাদের দোষ দেয়। বাস চালকদের কারণে নাকি জ্যাম হয়। কিন্তু বাস্তবতা একেবারেই ভিন্ন। আপনি যদি এই রোডের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ঘুরে দেখেন তাহলে দেখবেন যে সবাই যে যার আগে পারছে, যেতে চাইছে। কেউ কোনও সিরিয়াল মানছে না, ওভারটেক করার প্রবণতা সবার মধ্যে আছে। সবচেয়ে বড় কথা হকাররাতো পুরো সড়কই দখল করে আছে। এর মধ্যে আবার শত শত অটোরিকশা ও মিশুকের মত অবৈধ যানবাহন যানজটের মূল কারণ বলে আমি মনেকরি।
নগরবাসী ও যাত্রীদের মতে, বঙ্গবন্ধু সড়কে আইনশৃঙ্খলার যথেষ্ট ঘাটতি আছে। ৫ আগস্টের পর থেকে ট্রাফিক ব্যবস্থা খুব দুর্বল। এই রাস্তায় গাড়ি চলাচলের জন্য কোনও নিয়মনীতি নেই। কার, বাস ও রিকশার জন্য আলাদা লেন থাকলেও যে যার ইচ্ছেমত গাড়ী চালাচ্ছে। সড়কসহ সবজায়গাতেই অটোরিকশা আর মোটরসাইকেলের দৌরাত্ম। আর হকারদের নৈরাজ্যতো রয়েছেই। ফলে চারিদিকে শুধু জ্যাম আর জ্যাম। এ জ্যামের কারণে জনজীবনে চরম ভোগান্তির সৃষ্টি হলেও কেউ এগিয়ে আসছে না।
সমাধান কী
নগর পরিকল্পনাবিদদের মতে, বঙ্গবন্ধু সড়কে যত্রতত্রভাবে গাড়ি পার্কিংয়ের ফলে সবচেয়ে বেশি যানজট সৃষ্টি হয়। পুলিশ দেখেও কিছু বলে না। উল্টো পয়সা খেয়ে তাদের দীর্ঘসময় গাড়ি রাখার সুযোগ করে দেয়। তবে সবচেয়ে ভয়াবহের বিষয়টি হলো, হকার ও অবৈধ যানবাহনের দৌরাত্ম। এরা এখন অনেকটাই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। যানজট নিরসনের জন্য সবার আগে হকার ও অবৈধ যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। আর এ পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করলেও বঙ্গবন্ধু সড়কে কোন যানজট থাকবেনা বলেও অভিমত পরিকল্পনাবিদদের।
প্রশাসন কী বলছে
নগর পরিকল্পনাবিদদের সাথে একমত পোষন করে নারায়ণঞ্জ চাষাঢ়া ট্রাফিক পুলিশের এক সদস্য বলেন, অবৈধ ট্রাকস্ট্যান্ড, হকার ও আর অবৈধ যানবাহন যদি এখান থেকে সরে যায় তাহলে সত্যিকার অর্থেই যানজট কমে যাবে। এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের ভূমিকা পালন করা জরুরি।
সাধারণ মানুষের নৈতিক দায়িত্ব আছে উল্লেখ করে এই পুলিশ সদস্য বলেন, আইন আসলে সবার জন্য সমান। কিন্তু এখন কেউই আইন মানতে চায় না। এখন সবাই স্বাধীন। আইন শুধু এখন পুলিশের জন্য। অনেক শিল্পপতি, ব্যাংক কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ীরা তাদের গাড়ী অবাধে যেখানে সেখানে রাস্তার ওপর পার্কিং করা হয়। আর শুধু দোষ পড়ে গণপরিবহনের। যানজট নিরসনে সেনাবাহিনী আমাদের সহযোগীতা করছে। আমরা অনেক যানবাহনকে জরিমানা করেছি। সড়কে যেসব অবৈধ যানবাহন চলাচল করছে আমরা নিয়মিত অভিযান চালিয়ে জরিমানা আদায় করছি।
এদিকে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন সূত্রে জানাগেছে, সিটি করপোরেশনের জায়গার ওপর অবৈধ স্থাপনা থেকে শুরু করে সড়কের ওপর থাকা অবৈধ সবকিছু উচ্ছেদ হবে। তবে এক্ষেত্রে সিটি কর্পোরেশনের কিছু সময় লাগবে। পর্যায়ক্রমে অবৈধ সবকিছুর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।