কম দামের আশায় ফুটপাত থেকে ভেজাল ইফতার সামগ্রী কিনে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন নারায়ণগঞ্জ শহরের রোজাদারগণ। পবিত্র মাহে রমজানের রহমতের ১০ দিন চলে গেছে। বিকেলের আগেই ফুটপাতে মৌসুমী ইফতার বিক্রেতার দোকান শুরু হয়। শহরে ইফতার সামগ্রীর যথেষ্ঠ চাহিদার কারণেই ফুটপাতে মৌসুমী বিক্রেতারা ইফতার সামগ্রী বিক্রি করেন। কথা উঠেছে এ সকল ইফতার সামগ্রী কতটা স্বাস্থ্যসম্মত। ইফতারে রং ও ক্ষতিকর কেমিক্যাল ব্যবহারের বিরুদ্ধে তৎপর জেলা প্রশাসন। তবুও ইফতারে রং ও কেমিক্যাল এর ব্যবহার বন্ধ হয় না। সুধীমহলের মতে, ফুটপাত থেকে ইফতার সামগ্রী না কিনে ভাল কোন হোটেল থেকে কিনে ইফতার করাই শ্রেয়। নইলে রমজানের শেষের দিকে অনেক ধর্মপ্রাণ মুসলমান অসুস্থ হয়ে পড়েন।
ইফতারে বাহারি খাবার কার না খেতে ভালো লাগে। কিন্তু মুখরোচক এসব খাবার খেতে গিয়ে ঝুঁকিতে পড়ছে স্বাস্থ্য। ফুটপাতের দোকান, সাধারণ হোটেল বা কনফেকশনারির ইফতারের নানা পদে বিশেষ করে মাংসের পদে ব্যবহার হচ্ছে কৃত্রিম রং। দেখতে ভালো দেখাবে, ক্রেতারা আকৃষ্ট হবে এই আশায় রং ব্যবহারে মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। ফুড গ্রেডের কোনো রং ব্যবহার না করে সাধারণ কৃত্রিম রং, যা জর্দার রং হিসাবে পরিচিত তা ব্যবহার হচ্ছে ইচ্ছেমতো। পাশাপাশি মসলার ব্যবহারও হচ্ছে দেদার।
নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের আরএমও ডাঃ ফরহাদ হোসেন বলেন, প্রথমত খাবারে কৃত্রিম রং ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা নেই। কিন্তু তারপরও এই রঙের ব্যবহার করা হয় দেখতে ভালো লাগার জন্য। এতে খাবারের স্বাদ কিন্তু বাড়ে না। পুষ্টিগত দিক থেকে চিন্তা করলেও খাবারে কৃত্রিম রং ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা নেই। কিছু খাবারে প্রাকৃতিকভাবেই রং থাকে। সেগুলো যদি দেখতে সুন্দর দেখানোর জন্য ব্যবহার করা হয় সেটি আমরা নিতে পারি। তিনি বলেন, ক্যানসার, পেনক্রিয়াটাইটিস, গলব্লাডারে পাথর, অতিরিক্ত অ্যাসিডিটি, কোষ্ঠকাঠিন্য, আইবিএসের মতো সমস্যা এই ধরনের অবাঞ্ছিত রং ব্যবহারের মাধ্যমে হতে পারে। শিশুদের ক্ষুধামন্দা, খাবারে অরুচির ক্ষেত্রেও এই ধরনের কৃত্রিম রং দায়ী। যেহেতু এই ধরনের রং তাদের পেটে ঠিকঠাক মতো হজম হয় না সেহেতু পরে তাদের দীর্ঘমেয়াদি বা ক্রনিক ডায়রিয়া, কলেরা হয়ে থাকে। যার কারণে বাচ্চারা পরবর্তী সময়ে হেপাটাইটিসের মতো ভয়ংকর রোগে ভুগতে পারে।
একজন পুষ্টিবিদ বলেন, কিছু কিছু ক্ষেত্রে বাজারজাতকরণের জন্য বা ইন্ডাস্ট্রিয়ালাইজেশনে যে খাবারগুলো রয়েছে যা অনেকদিন ধরে ব্যবহার করার তাগিদ থাকে। সেসব ক্ষেত্রে কিছু কৃত্রিম রং ব্যবহার করা হয় ফুড গ্রেড মেনে। এফডিএ অনুমোদিত সেই ফুড গ্রেডের মধ্যে কিছু কালার আছে সেগুলো আমরা ব্যবহার করতে বলি।
বাজারে দেদার বিক্রি হওয়া জর্দার রঙের বিষয়ে তিনি বলেন, জর্দার রং বলে ফুড গ্রেডে কোনো রং নেই। ফুড গ্রেডে যে ধরনের রং ব্যবহার করা হয় সেগুলোকে একটি কোডের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়। সেই কোডের অধীনে এগুলো বিক্রি করা হয়। এই রংগুলো ব্যবহারের সঠিক মাত্রাও আছে। সে অনুযায়ী ব্যবহার করা হচ্ছে কি না সেটিও দেখতে হবে।
বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের (বিএফএসএ) নারায়ণগঞ্জ জেলা অফিসারের মতে, কোনো ইফতারি প্রস্তুত ও বিক্রয়ের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ইচ্ছাকৃতভাবে গলদ করলে কঠিন শাস্তি দেওয়া হবে। আমরা সচেতন করছি। কীভাবে নিরাপদ ইফতারি প্রস্তুত করা হবে সেটা শেখাচ্ছি। তারপরও নিয়ম না মানলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ বছর রমজানে ইফতারের খাবার নিরাপদ করতে আগের চেয়েও বেশি তদারকি কার্যক্রম চালানো হবে।
২০২৩ সালে প্রথম রোজা থেকেই নগরীতে ভেজাল বিরোধী অভিযান চলেছে। তখনকার নারায়ণগঞ্জ অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মৌসুমী বাইন হীরা জানিয়েছিলেন, আমরা রমজানের শুরু থেকেই এ বিষয়ে সোচ্চার। জেলায় ২০ টি ভেজাল বিরোধী অভিযান পরিচালিত হয়েছে। জরিমানা আদায় হয়েছিল ১ লাখ ৯০ হাজার টাকা। প্রতিবছর এই অভিযান চলমান থাকে। তাছাড়া গতবছর বাজার মনিটরিং ও ভেজাল বিরোধী ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনায় মাঠে প্রতিদিন ৩টি টীম কাজ করেছিল। প্রতিদিন অন্তত দু’টি অভিযান পরিচালিত হত। প্রতিবছর রমজান মাসে জেলা প্রশাসনের অভিযান সত্ত্বেও খাদ্যে ভেজাল কমেনা বলে অভিযোগ উঠেছে সুধীমহলের পক্ষ থেকে। পুষ্টিবিদরা বলছেন, ভেজাল ইফতার সামগ্রীতে ক্যানসারসহ নানা রোগের মারাত্মক ঝুঁকি আছে।
জানাগেছে, আজ ৭ রোজা চলছে। এখনো জেলা প্রশাসন ইফতার সামগ্রীতে ভেজালের বিষয়ে কোন অভিযান শুরু করেনি। আপাতত কঠোরভাবে বাজার মনিটরিং চলছে। শহরবাসী ভেজাল ইফতার সামগ্রীর বিষয়ে মোবাইল কোর্টের অভিযানের দাবি করেছেন। তাদের মতে, আমরা কষ্ট করে সিয়াম সাধনা করি আর কিছু লোক জেনেবুঝে রোজাদারদের ক্ষতি করছে ইফতার সামগ্রীতে ক্ষতিকর কেমিক্যাল মিশিয়ে। এতেকরে আমাদের স্বাস্থ্যগত সমস্যা হচ্ছে। আমরা ধীরে ধীরে ক্যান্সারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। রমজান মাস শুরু পর গত ১৬ মার্চ কনজ্যুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) এর নারায়ণগঞ্জ জেলার নেতৃবৃন্দ চাষাড়ায় ইফতারীর দোকানে অভিযান চালিয়ে ছিল। মনিটরিংয়ের নেতৃত্ব দিয়েছেন, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষন কমিটির সদস্য ও ক্যাব, নারায়ণগঞ্জে যুগ্ম সম্পাদক বিল্লাল হোসেন রবিন। উপস্থিত ছিলেন, ক্যাব, জেলা কমিটির সদস্য রোকনুজ্জামান মিঠু, ক্যাব, নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলা কমিটির সভাপতি ডা. গাজী খায়রুজ্জামান প্রমুখ।
চাষাড়া থেকে মিশনপাড়া পর্যন্ত নবাব সলিমুল্লাহ সড়কের দুইপাশে সুগন্ধা বেকারী, সুগন্ধা রেস্টুরেন্ট, সুমাইয়া বিরিয়ানী, এটেল মাটি রেস্টুরেন্ট, ফুডল্যান্ড, সুলতান ভাই রেস্টুরেন্ট, সুইটনেশন, প্যারিস বাগেত, বৈশাখী রেস্টুরেন্টসহ ছোট ছোট ইফতারের দোকান মনিটরিং করা হয়। এ সময় দোকানীদের তৈরীকৃত ইফতার ঢেকে রাখা এবং সরবরাহ করার সময় স্টাফদের মাথায় ক্যাপ, মুখে মাস্ক, হাতে গ্লাভস লাগানোর জন্য বলা হয়। খোলাভাবে তৈরীকৃত ইফতারী বিক্রি করা যাবে না বলে জানানো হয়। পাশপাশি কোন অবস্থাতেই যেন বাসি ইফতার বিক্রির চিন্তা করা না হয়। এসব নিয়ম না মানলে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনে কি কি শাস্তি হতে পারে সেই সংক্রান্ত হ্যান্ডবিল বিতরণ করা হয় ইফাতার বিক্রেতাদের মাঝে। এছাড়া চাষাড়া মার্ক টাওয়ারের পাশে ও প্রেসিডেন্ট রোডে দুটি ইফতারী বিক্রির দোকান মনিটরিং করা হয়। মনিটরিং টিম দেখে অনেকেই পাতলা প্ল্যাস্টিক দিয়ে তাদের ইফতারী ঢেকে দেন।
জানা গেছে, ইফতারি পণ্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় সোডিয়াম হাইড্রোসালফাইড (কস্টিক সোডা) ও সোডিয়াম সাইক্লামেট। জিলাপিসহ বিভিন্ন ইফতারি আইটেমে এসব রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়। যা মানবদেহের জন্য খুবই ক্ষতিকর। তাছাড়া বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক রং ব্যবহার করা হয় ইফতারি পণ্যে। শুধুমাত্র বেশি সুস্বাদু ও আকর্ষণীয় দেখানোর জন্য এসব কৃত্রিম রং ও রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়ে থাকে। আর এ কারণে ইফতারির সব খাবার অনিরাপদ হয়ে উঠে।
সরেজমিন নগরীর চাষাড়া, কালিরবাজার, দ্বিগুবাবুর বাজার, উকিলপাড়া, ডিআইটি মার্কেট, লঞ্চ টার্মিণাল, টানবাজার, নিতাইগঞ্জ ও আশপাশ এলাকা ঘুরে ঘুরে দেখা যায়, সেখানে কোথাও চিকেন টিক্কা, শিক কাবাব, জিলাপিসহ নানা পদে খোলাবাজারে পাওয়া কৃত্রিম রং দেদার ব্যবহার করা হয়। কাবাব পোড়ানোর স্থানের পাশেই রাখা হয়েছে রং ও মসলামিশ্রিত পাত্র। সেখান থেকে তা বারবার মাংসে ব্যবহার করা হয়।
রোজা শুরুর পর থেকে ২নং রেলগেইট, কলেজ রোড ও চাষাড়ার ফুটপাতে বিশেষ করে রামকৃঞ্চ মিশনের সামনে ফুটপাতে ভেজাল ইফতার সামগ্রী বিক্রি হয়। ইফতার বাজার-সবখানে মাংসের পদে অতিরিক্ত তেল ও মসলার ছড়াছড়ি চোখে পড়ছে। এসব বিষয়ে ক্রেতাদের অনেকেই খেয়াল করেন না। অনেকে আবার জেনে-বুঝেও বিষয়গুলোকে এড়িয়ে যান।